কে ছিলেন চৈতন্য মহাপ্রভু?

ডেস্ক: ১৪৮৬ খ্রিঃ ১৮ ই ফেব্রুয়ারী ফাল্গুনী পূর্ণিমার পুন্য তিথিতে জন্ম গ্রহণ করেন। নবদ্বীপের আকাশে আর গঙ্গার বুকে জোছনার জোয়ার উথূলে উঠেছে। সেদিন আবার চন্দ্রগ্রহণের যোগ। কোলাহল আর হরিধ্বনিতে আকাশ – বাতাস ভরপুর । এমন সময় মায়াপুর পল্লীতে শ্রীহট্টিয়া পাড়ায় নারীকণ্ঠের ঘন ঘন উলুধ্বনি শোনা গেল। শাঁখ বেজে উঠলো চারিদিকে। কি ব্যাপার? – শোনা গেল এইমাত্র পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্রের ঘরে তার স্ত্রী শচীদেবী একটি পুত্র সস্তানের জন্ম দিয়েছেন।

জগন্নাথ মিশ্রের প্রথম ছেলের নাম বিশ্বরূপ। পরপর কয়েকটি ছেলে – মেয়ের মৃত্যুর পর এই ছেলের জন্ম। মা শচীদেবী তাই নবজাতকের নাম রাখলেন নিমাই। কোষ্ঠীর নাম ‘ বিশ্বম্ভর। ডুবনভোলানো রূপ নিমাইয়ের। একবার দেখলে চোখ ফেরানো কঠিন । বাপ – মায়ের তো বটেই, পাড়া – পড়শীদেরও সে নয়নের মণি। দিনে দিনে বাড়ে চাঁদের কলার মত। শচীমার বুকের ধন, চোখের মণি আঙিনায় খেলা করে। মা যশোদা যেমন তাঁর নয়নমণি শ্রীকৃষ্ণকে সাজাতেন তেমনি ক’রে শচীমাতাও সাজিয়ে দেন নিমাইকে। চঞ্চল অস্থির শিশু কারও কথা শোনে না। লেখাপড়ায় তার এতটুকুও মন নেই। সারাদিন , শুধু খেলা করে আর নেচে বেড়ায় ।

পাঁচ বছরে নিমাইয়ের হাতে খড়ি হলো। হাতে খড়ির দিন দেখা গেল, বালকের মেধা ও প্রতিভা দুই – ই বিস্ময়কর। বিদ্যালয়ের পাঠ অনায়াসেই সে আয়ত্ত করে। পুত্র গৌরবে মায়ের মন খুশিতে ভরে ওঠে। নিমাইয়ের বয়স যখন প্রায় সাত বছর, তখন তার বড় ভাই বিশ্বরূপ ষোল বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে সংসার ছেড়ে চলে যান। জগন্নাথ মিশ্র ভেঙ্গে পড়েন। চোখের জলে বুক ভাসাতে থাকেন শচীমা । নিমাই বলেন” কেঁদো না মা। দাদা সন্ন্যাসী হয়েছেন কিন্তু আমি তো আছি। আমি তোমাদের দেখব। ”

পাছে বড় ছেলের মত নিমাইও লেখাপড়া শিখে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যায় এই ভয়ে জগন্নাথ মিশ্র নিমাইয়ের লেখাপড়া বন্ধ ক’রে দিলেন। কিন্তু লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়াতে বালক নিমাই এক দুরন্ত বালকে পরিণত হলেন। তাঁর অত্যাচারে ও দুরত্তপনায় নবদ্বীপের সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন।
সাত বছরের ছেলে নিমাই কখনও কলাবাগান থেকে পাকা কলা চুরি করে খান, কখনও বা গঙ্গার জল তোলপার করে সাঁতার কাটেন । গঙ্গায় স্নানরত ব্রাহ্মণদের কাপড় – চাদর জলে ভিজিয়ে দেন , কখনও লুকিয়ে রাখেন । আবার কখনও বা কারও পূজার আসনে গিয়ে বসে নৈবেদ্যের ফলমূল খেয়ে পালিয়ে যান। গঙ্গাতীরে শিবলিঙ্গ সামনে রেখে কোন ব্রাহ্মণ হয়তো ধ্যানে বসেছেন । নিমাই নিঃসাড়ে সেখানে গিয়ে সেই শিবলিঙ্গ চুরি করে পালিয়ে যান। এমনি আরও অনেক অপকর্ম করে বেড়ান নিমাই।

নবদ্বীপ শহরে মুকুন্দসঞ্জয় নামে একজন বর্ধিষ্ণু লোক ছিলেন। তার বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে নিমাই টোল খুলে অধ্যাপনা করতে বসলে । নিমাইয়ের প্রতিভা ও পাণ্ডিত্যের খ্যাতি চারিদিকে প্রচারিত হতে লাগলো। দূর দূর থেকে ছাত্ররা আসতে লাগলো নিমাই পণ্ডিতের টোলে। টোল জমে উঠতে দেরি হলো না। ধনী ও প্রতিপত্তিশালী নাগরিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় অচিরে নিমাই বেশ গণ্যমান্য হয়ে উঠলেন।

নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে নিমাইয়ের বিয়ে হয়েছিল।

বিয়ের কিছুকাল পরে নিমাই গেলেন পূর্ববঙ্গে। কিছুকাল পরে নবদ্বীপে ফিরে এসে শুনলেন লক্ষ্মীদেবী সাপের কামড়ে মারা গেছেন। শোক ভুলে থাকবার জন্যে অধ্যাপনার ওপর জোর দিলেন। রাতারাতি হয়ে উঠেছেন গাম্ভীর্যের প্রতিমূহূর্ত।কিছুকাল পরে শচীদেবী আবার ছেলের বিয়ে দিলেন। নবদ্বীপের সনাতন পণ্ডিতের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে। সংসারে আবার আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। কিন্তু আনন্দময় এই জীবন কয়েক বছর পর হঠাৎ একদিন বিপর্যস্ত হয়ে গেল। আর সে বিপর্যয় এল নিমাইয়ের অলৌকিক ভাবমত্তার মধ্য দিয়ে দমকা হাওয়ার মত।

বিবাহের অল্পকাল পরে নিমাই স্বর্গত পিতার পিণ্ডদান করতে গেলেন গয়াধামে। সেখানে শ্রীবিষ্ণুর পাদপদ্ম দর্শনের পর তাঁর মধ্যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা দিত । তাঁর মধ্যে জন্ম হল শ্রীকৃষ্ণ অনুরাগী এক প্রেমিক সাধকের। অহঙ্কারী পন্ডিত নিমাই হলেন শ্ৰীকৃষ্ণসাধক। গয়ায় ওই সময় বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক মাধবেন্দ্র পরীর শিষ্য ঈশ্বরপুরী নামে এক শ্রীবিষ্ণুভক্ত সাধু ছিলেন। নিমাই তাঁকে দেখে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে বললেন“ প্রভু আমাকে দীক্ষা দিন। ” ঈশ্বরপুরী জানতেন — নিমাই একজন পরম ভক্ত। তিনি নিমাইকে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা দিলেন। এরপর তিনি ফিরে এলেন নবদ্বীপে। সারা মন তার কৃষ্ণনামে ভরা । কৃষ্ণনাম করতে করতে তিনি কাঁদেন , কখনও বা মূর্ছিত হয়ে পড়েন।

নবদ্বীপের শাসনকর্তা তখন একজন মুসলমান কাজী। বৈষ্ণবদের কীর্তন নিয়ে এই মাতামাতি হৈ – হুল্লোড় তিনি ভাল চোখে দেখতেন না। তিনি আদেশ জারী করলেন , নবদ্বীপে সমবেতভাবে কীর্তন করা চলবে না। তাই শুনে নিমাই ক্রোধে রুদ্রমূর্তি ধারন করলেন। সেই দিনই তিনি হাজার হাজার ভক্ত নিয়ে শ্রীহরির নাম গান করতে করতে পথে বেরলেন। সারা শহর প্রদক্ষিণ করে অবশেষে কাজীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। নিমাইয়ের ভগবদ্ভক্তি ও মধুর নাম গান শুনে কাজীর মনের পরিবর্তন হলো। তিনি তাঁর আদেশ তুলে নিলেন। সারা নবদ্বীপ কৃষ্ণনাম গানে ভরে গেল।

জাতিবর্ণ ধর্ম নির্বিশেষ সকল মানুষের মধ্যে প্রেমের বাণী প্রচার করেছিলেন শ্রীচৈতন্য। এর বাইরে তিনি অন্য কোন ধর্মত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেননি। কোন ধর্মগ্রন্থও রচনা করেন নি। মানবীয় চেতনার পূর্ণবিকশিত, রূপবিগ্রহ ছিলেন তিনি। মানুষে মানুষে বিভেদ মুছে দেবার ব্রতই ছিল তাঁর জীবনসাধনা । সন্ন্যাসী হলেও তিনি আত্মমুক্তিকামী বা মানবতা বিমুখী ছিলেন না। সেই আকর্ষণেই হাজার হাজার মানুষ তার কাছে ছুটে আসত, লাভ করত জীবনের আলো। তিনি সকল মানুষের জন্য যে মহানাম প্রচার করে গেছেন তা হলো –” হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।”

জীবনের শেষ আঠারোটি বছর পুরীধামে কাটিয়েছিলেন। পুরীধামে ১৫৩৪ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ শে জুন শ্রীচৈতন্যদেব চিরতরে অন্তর্হিত হয়ে যান। তিনি সেই সময় প্রচার করেন—“ ঈশ্বরের আরাধনায় সকলের সমান অধিকার। প্রাণে ভক্তি নিয়ে ঈশ্বরকে ডাকলে পাওয়া যায়। ভক্তিতেই মুক্তি । ”