কিভাবে চণ্ডাশোক থেকে রূপান্তরিত হল ধর্মাশোকে?

ডেস্ক: মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট অশোক ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট হিসেবে বিবেচিত। পিতা বিন্দুসারের মৃত্যু পরবর্তীকালে সম্রাট অশোক সিংহাসন আরোহণ করেন এবং দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ ছাড়া ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চলই তাঁর সুবিশাল সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিন্দুসারের ২৭ বছর রাজত্বকালের পর এবং তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর পুত্রদের মধ্যে ‘অশোক’,”প্রিয়দর্শী” উপাধি নিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দে মগধের সিংহাসনে বসেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর রাজ্য অভিষেক হয় চার বছর পরে। বিস্ময় পৃথিবীর সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক নাকি বাল্যকালে অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন। সিংহলের “মহাবংশ” নামে পালি গ্রন্থে লেখা আছে অশোক তার অন্যান্য ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে বসে ছিলেন। এই কারণে তাঁকে ‘চণ্ডাশোক’ বলা হয়ে থাকে।

অভিষেকের আট বছর পর ওড়িশার বৈতরণী নদী থেকে গোদাবরি সন্নিহিত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত পরাক্রান্ত কলিঙ্গ রাজ্যটি তিনি আক্রমণ করেন এবং জয়লাভ ও করেন। তবে জয়লাভ করলেও যুদ্ধের পরিণতি অশোককে বিশেষ ভাবে ব্যথিত করেছিল। যুদ্ধে, দুর্ভিক্ষে, মড়কে কলিঙ্গ শ্মশানে পরিণত হয়। যুদ্ধের এই ভীষণ অভিশাপে সম্রাটের মনে দুঃখের প্লাবন বয়ে যায়। জীবের দুঃখ একদিন যেমন গৌতমকে পরিণত করেছিল বুদ্ধে; তেমনি কলিঙ্গ যুদ্ধ ‘চণ্ডাশোক’ কে রূপান্তরিত করল ‘ধর্মাশোকে’ ।

মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমা অশোকের রাজত্বকালেই সবথেকে বেশি প্রসারিত হয় । উত্তর পশ্চিমে তাঁর সাম্রাজ্যের সীমা তৎকালীন সিরিয়ার রাজার সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু দেশ তার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল । উত্তরে নেপাল ও কাশ্মীর তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল ।দূর দক্ষিণে চের, চোল, পাণ্ড্য ও পল্লব রাজ্যকে অশোককের শিলালিপিতে সাম্রাজ্যের বাইরে মিত্র রাজ্যব্যাপী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

পূর্বদিকে অশোকের সাম্রাজ্য খুব সম্ভবত ব্রহ্মপুত্র নদ ও পশ্চিমে আরব সাগর ও সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পরে রাজর্ষি অশোক বুদ্ধের বাণী প্রচারের মধ্য দিয়ে জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেন । বৌদ্ধধর্মীয় মহান আদর্শ জগতে প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত। ফলে তাঁর এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পূর্ব ভারতে একটি আঞ্চলিক ধর্ম ধীরে ধীরে বিশ্ব ধর্মে পরিণত হয়েছিল।

ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে অশোক বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন । তিনি’ধর্ম মহামাত্র” নামে এক শ্রেণির রাজকর্মচারী নিযুক্ত করেন এবং তাদের ওপর ধর্মপ্রচার ও জনকল্যাণমূলক কাজের ভার দেওয়া হয় । সাম্রাজ্যের নানা স্থানে, পাথরের স্তম্ভে ,পাহাড়ের গায়ে ধর্মের বাণীগুলো সাধারণের বোধগম্য প্রাকৃত ও ব্রাহ্মী ভাষায় উৎকীর্ণ করা হয়। এগুলিকে ধর্ম লিপি বলা হত। এ সব ধর্ম লিপি ছাড়াও অশোক শান্তি, মৈত্রী ও অহিংসার প্রতীক হিসেবে স্তূপ, স্তম্ভ এবং চক্র ইত্যাদি নির্মাণ করান। সাঁচি স্তূপ, সারনাথ ও অশোকস্তম্ভ তারই নিদর্শন। এছাড়া জনসাধারণের মনে ধর্মভাব জাগানোর জন্য অশোক একদিকে যেমন ধর্মোৎসব এবং অলৌকিক দৃশ্য দেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন ;অন্যদিকে তেমনি নিজেই প্রমোদ ভ্রমণের পরিবর্তে ধর্মপ্রচারে বের হন। এটি ‘ধর্ম যাত্রা’ নামে পরিচিত ছিল. শুধু তাই নয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মতবিরোধ দূর করার জন্য রাজধানী পাটলিপুত্রে অশোক তৃতীয় বৌদ্ধ সংগতির আহ্বান করেছিলেন ।

শুধুমাত্র নিজের সাম্রাজ্যের মধ্যে ই নয় সাম্রাজ্যের বাইরে ও ভারতবর্ষে অন্যান্য রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অশোক ধর্ম দূত পাঠিয়েছিলেন। তাই সুদূর দক্ষিণে চোল ,পাণ্ড্য , কেরলপুত্র ,সত্যপুত্র প্রভৃতি রাজ্য এবং উত্তরে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে তিনি ধর্ম দূত পাঠিয়েছিলেন ।

অশোক ব্যক্তিগত জীবনে গোঁড়া বৌদ্ধ ছিলেন কিন্তু প্রজাসাধারণের কাছে তিনি যে উপদেশগুলি প্রচার করেন তা যে কেবলমাত্র বৌদ্ধধর্মের ই প্রচারপত্র ছিল তা বলা যায় না। সকল ধর্মের প্রতি উদার ও শ্রদ্ধাশীল অশোক সমস্ত ধর্মের মূল নীতিগুলোকেই গ্রহণ করেছিলেন এবং তার ধর্মের মূল কথা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তাই অশোক প্রচারিত ধর্মে আর্যসত্য ,অষ্টাঙ্গিক মার্গ নির্বাণ লাভ প্রভৃতি বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্যে সুস্পষ্ট অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সকল জীবের প্রতি দয়া, অহিংসা ,পরধর্মসহিষ্ণুতা ,সত্য কথা বলা নিজেকে সত্য রাখা, সৎ রাখা ,দান ,পিতামাতা গুরুজন এবং সাধু সজ্জনদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা ,নিষ্ঠুর আমোদ প্রমোদ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি প্রধান আচরণ হিসাবে গৃহীত হয়েছিল।
মানবতা ,পরধর্ম সহিষ্ণুতা, জন্য কল্যাণকর শাসন যদি রাজা- মহারাজা দের মাহাত্ম্য ও খ্যাতির মাপকাঠি হয় তাহলে ইতিহাসে মৌর্য সম্রাট অশোকের স্থান যে সর্বোচ্চ সে বিষয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ থাকে না । শত সহস্র রাজার ভিড়েও তিনি সেখানে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক । হত্যা ও ধ্বংসের মাধ্যমে রাজ্য বিজয় অপেক্ষা মৈত্রী ও প্রেমের মাধ্যমে মানুষকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা ছিল তাঁর কাজ ।এই উপলব্ধি দিগ্বিজয়ী সম্রাট অশোককে ধর্ম বিজয়ের মধ্যে দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাটে রূপান্তরিত করে। তিনি সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করতেন ।

অশোক ছিলেন যথার্থই মহামতি; মানবজাতির প্রথম ধর্মগুরু। সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের নীতি অনুসরণ করে জনকল্যাণকর শাসনের মধ্যে দিয়ে মানবতার যে বাণী অশোক প্রচার করে গেছেন ভারতীয় সংস্কৃতি হল তাঁরই মূল বাহক। মানুষও শাসক হিসেবে তাঁর তুলনা করা চলে না তাতাই একথা বলতে অত্যুক্তি হয় না যে বিশ্বে শান্তির অগ্রদূত রাজর্ষি অশোক কেবলমাত্র ভারতেই নয় সারা বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *